চুক্তিভিত্তিক উপদেষ্টা: বছরে ব্যয় অর্ধ কোটি টাকা

ঢাকা ওয়াসার জনবল কাঠামো লঙ্ঘন করে মধ্যবর্তী স্থানে লোক নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে ৮ আগস্ট ২০১৫ তারিখে সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আমরা ঢাকার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-
ঢাকা ওয়াসার জনবল কাঠামোয় (অর্গানোগ্রাম) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পর রয়েছে চারটি উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ। এরপর একজন প্রধান প্রকৌশলী। তারপর আছেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীসহ অন্যান্য পদ। সেই অর্গানোগ্রাম লঙ্ঘন করে মধ্যবর্তী স্থানে লোক নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে নিয়মকানুনের কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। এ জন্য এক ব্যক্তির পেছনেই ঢাকা ওয়াসার বছরে খরচ করতে হচ্ছে অর্ধকোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, নিয়ম লঙ্ঘন করে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব প্রদান, ওয়াসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব শাখার সব কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব দেওয়া, সর্বোপরি আর্থিক বিষয় যুক্ত থাকা সব ফাইল তার স্বাক্ষরে উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের দপ্তরে পাঠানোর আদেশ জারির মতো ঘটনাও ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে ওই পদে দায়িত্ব পালনরত বজলুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে তার কার্যালয়ে গেলেও তিনি সমকালের সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) আতাউর রহমান সমকালকে বলেন, এসব ঘটনা কীভাবে ঘটল, তা বলা মুশকিল।
নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ-সংক্রান্ত সব অফিস আদেশের কাগজ সচিবের দপ্তর থেকে ইস্যু করা হয়েছে। আদেশগুলোতে সচিব বা উপসচিবের স্বাক্ষর রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার সচিব রেজাউল মোস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, তিনি নতুন এসেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি জানতে পারেন, ওই ভদ্রলোক আগে ওয়াসায় প্রধান প্রকৌশলী পদে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ জন্য অবসর শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে তাকে আবার ওয়াসায় আনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই সময় তিনি দায়িত্বে ছিলেন না। কাজেই কীভাবে হয়েছে, তা তিনি জানেন না।
ওই সময় ঢাকা ওয়াসায় সচিবের দায়িত্বে থাকা মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কাজী ওয়াছিউদ্দিন সমকালকে বলেন, ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সিদ্ধান্তে এসব অফিস আদেশে তিনি স্বাক্ষর করেছেন।
যেসব অনিয়ম :ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী বজলুর রহমান ২০১৪ সালের ৬ অক্টোবর অবসরকালীন ছুটিতে যান। ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর তার পূর্ণ অবসরে যাওয়ার কথা থাকলেও অবসরকালীন ছুটিতে যাওয়ার আট দিনের মধ্যে ১৪ অক্টোবর তাকে চাকরি থেকে পূর্ণ অবসর দেয় ওয়াসা। এর দু’দিন পর ১৬ অক্টোবরেই তাকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের উপদেষ্টা হিসেবে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই দিনই তিনি উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করেন। এর কিছুদিন পর ৬ নভেম্বর একই দিনে পদ্মা (জশলদিয়া) পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রশিদ সিদ্দিকীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে বজলুর রহমানকে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। একই দিনে তাকে ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব জোন ৩, ৪, ৫, ৬, ৮, ৯ ও ১০-এর কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ওয়াসার সচিব ওয়াছিউদ্দিন আরেকটি অফিস আদেশ জারি করেন, যার মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসার বাস্তবায়নাধীন ও বাস্তবায়ন হবে এমন সব প্রকল্প ও অফিসের সব নথি বজলুর রহমানের মাধ্যমে উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। রহস্যজনক কারণে সব আদেশই অতি দ্রুততায় সম্পন্ন হয়।
ওয়াসার কর্মকর্তারা জানান, অর্গানোগ্রাম লঙ্ঘন করে নিয়োগ দেওয়ার পর তাকে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যা প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ, জশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্পটি আগামী দুই বছরের মধ্যে কোনোভাবেই বাস্তবায়ন হবে না। অথচ বজলুর রহমানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দুই বছরের জন্য। এ ছাড়া ৪০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পে বহিরাগত ব্যক্তিকে নিয়োগ অনৈতিক বলে অনেকে মনে করেন। এ জন্য আগের প্রকল্প পরিচালক রশিদ সিদ্দিকীকে সরানোর ক্ষেত্রেও অনিয়ম হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব আদায় হয় শত শত কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কাউকে দায়িত্ব দিলে তার দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
জানা গেছে, বজলুর রহমানকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগে তার বেতন ধরা হয়েছে মাসিক এক লাখ ২০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে ওয়াসা থেকে তাকে সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য ৭৬ লাখ টাকা মূল্যের একটি বিলাসবহুল পাজেরো স্পোর্টস গাড়ি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাসা ও ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করার জন্য দেওয়া হয়েছে একটি টেলিফোন ও মোবাইল ফোন। দুটির পুরো বিলই ওয়াসা বহন করছে। এ ছাড়া আছে বেতনের সমপরিমাণ বার্ষিক উৎসব ভাতা। ঢাকা ওয়াসার পরিবহন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, উপদেষ্টাকে যে গাড়ি দেওয়া হয়েছে, তার মাসিক ভাড়া দুই লাখ টাকা। এ হিসাবে বছরে তার জন্য গাড়ি ভাড়াই যাবে ২৪ লাখ টাকা। সাকল্যে এক ব্যক্তির পেছনেই ঢাকা ওয়াসাকে বছরে গুনতে হবে অর্ধকোটি টাকা।
You must be logged in to post a comment Login