মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা প্রচলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই নেতৃত্ব দিতে হবে: ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: July 1, 2015
SIC Sir

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫ বছরে পদার্পন উপলক্ষ্যে সমকাল পত্রিকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। আমরা ঢাকার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হল-

সমকাল: আমরা জানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আপনার জীবন ও কর্মে কতটা জড়িয়ে রয়েছে। এই সাক্ষাৎকার যেদিন প্রকাশ হবে, সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এর মধ্যে ৬৩ বছর আপনি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন। আজকের বাংলাদেশের প্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আপনি কীভাবে দেখেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের কারণে পূর্ববাংলার মানুষের মনে যে আশা জেগেছিল, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের মধ্য দিয়ে তা হতাশায় পরিণত হয়। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাজনৈতিক কারণে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর সামাজিক তাৎপর্য ছিল ব্যাপক। অবিভক্ত বাংলায় একটি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের পক্ষে সেখানে গিয়ে পড়াশোনা কঠিন ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববঙ্গে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ লাভ করে। এখানকার মেয়েরাও উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাস করে প্রশাসনে ও বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হতে থাকে, এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ফলে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজ গঠনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ব্যাপক।

সমকাল: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত পার্থক্য কী কী ছিল?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম থেকেই আবাসিক ব্যবস্থা ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা ছিল না। এছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু পূর্ববঙ্গের গর্বের প্রতিষ্ঠান, ঢাকার অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত বাসিন্দারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য লজিং ব্যবস্থা নিয়ে উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে আসে। সেখানে থেকে পরিবারের সন্তানদের পড়াত শিক্ষার্থীরা। এর ফলে পূর্ববাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও মধ্যবিত্ত তো বটেই, কৃষকের সন্তানরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা চালাতে পারত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে এই সুযোগ ছিল না।

সমকাল: পূর্ববাংলার বাঙালি হিন্দুরা আগে থেকেই আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অংশ নিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি মুসলিম সমাজে কী পরিবর্তন এনেছিল?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বাঙালি মুসলমানদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এক বিরাট সুযোগ ও সম্ভাবনার দ্বার। বিশেষ করে দেশবিভাগের পর। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিপুল অধিকাংশ ওপার বাংলায় চলে যায়। মেধাবী শিক্ষকরা চলে যাওয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ক্ষতি হয়েছে ঠিকই, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল ছিল। তখন কলেজ থেকেও অনেক মুসলিম শিক্ষক এসে সেই শূন্যস্থান পূরণ করেন, যারা কোনোদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার স্বপ্ন দেখেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি হওয়ার সুযোগও বেড়ে যায়। তারা পাস করে প্রশাসনে, শিক্ষকতায়, আইন পেশায়, সওদাগরি অফিসে চাকরি পেতে থাকে। বিদেশেও উচ্চশিক্ষার জন্য যায় অনেকে। বাঙালি মুসলিম সমাজে এতে করে ব্যাপক গুণগত পরিবর্তন আসে। এ সময়ই মূলত শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, সমাজসচেতন বাঙালি মুসলিম সমাজ গড়ে ওঠার স্বর্ণযুগ। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অবদান।
সমকাল :সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসলে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয় পাকিস্তান আন্দোলনে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেল, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শেষ হয়নি। বাঙালি হিন্দুদের জায়গায় পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালিরা এসে গেছে। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসনিক পদ, পেশাগত অবস্থান দখল করে নিচ্ছে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও তার ঢেউ লাগে। আগে বাঙালি মুসলমানদের প্রতিযোগিতা ছিল বাঙালি হিন্দুদের সঙ্গে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেই প্রতিযোগিতা শুরু হলো অবাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে। পাকিস্তানের ‘জাতির জনক’ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তো ১৯৪৮ সালেই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বাঙালিদের দাবি উপেক্ষা করে ঘোষণা দিলেন যে ‘উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’।

সমকাল: আপনি তখন কোথায় পড়তেন, সেই সভায় কি উপস্থিত ছিলেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা কিন্তু দিলেন ইংরেজিতে। গোটা বক্তব্যই ইংরেজিতে ছিল। জাতির জনক রাষ্ট্রভাষা উর্দুতে কথা বলতে পারতেন না! আমি তখন স্কুলের ছাত্র। বড়দের সঙ্গে কৌতূহলবশত দেখতে গিয়েছিলাম। আমার পরিবার তো দেশভাগের কারণে কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিল। ফলে নতুন রাষ্ট্রের ব্যাপারে আগ্রহ বেশি ছিল। দেখলাম, তিনি যখন ওই ঘোষণা দিলেন, তখন গোটা সভার উৎসাহ যেন নিভে গেল। সভার মাঝামাঝি জায়গায়, যেখানে ছাত্ররা বসেছিল, সেখানে সীমিত চাঞ্চল্যও হলো। আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম এবং হতাশা নিয়ে জনসভা থেকে ফিরে এলাম। দুই দিন পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনেও তিনি যখন একই ঘোষণা দেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তার মুখের সামনেই ‘নো নো’ বলে প্রতিবাদ করে। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এবং এর নেতৃত্বেই তখন থেকে জন্ম হতে থাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। পাকিস্তান আন্দোলনের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ দ্রুতই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হতে থাকে। বাঙালিরা হতাশা ও বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল, তারা আন্দোলন করে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, তার ডাকটিকিটে, মুদ্রায়, মানিঅর্ডার ফরমে বাংলা নেই; শুধু উর্দু ও ইংরেজি। এসব প্রতীকী বিষয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ উসকে দেয়। আসলে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার ব্যাপক প্রভাবাধীন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে রাজনৈতিক সচেতনতার একটা স্তর অতিক্রম করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেহেতু গোটা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করত এবং তারা নিজেদের সমাজ ও পরিবারে বিশেষ মর্যাদা পেত; তাদের এই রূপান্তর গোটা দেশের সমাজে রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটাতে থাকে। শ্রমজীবী, কৃষক, ব্যবসায়ী সমাজও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে সোচ্চার হতে থাকে।

সমকাল: রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক রূপান্তরের তাৎপর্য কী ছিল?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এর প্রধান তাৎপর্য ছিল ১৯৫৪ সালে, রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাত্র সাত বছরের মাথায় পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ও বাঙালি নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়। এর অনুপ্রেরণাও কিন্তু সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এসেছিল। ১৯৫২ সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ১৯৫৩ সালের শেষ দিকে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন। সেখানে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যুক্তভাবে নির্বাচন করে এবং প্রত্যেক হলে বিজয়ী হয়। মুসলীম লীগ সমর্থক ছাত্র সংগঠনের ভরাডুবি ঘটে। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে বার্তা গেল যে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থিরা একত্র হলে মুসলিম লীগ পরাজিত হবে। যে কারণে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং দুটি নিবৃত্তিমূলক আইন জারি করে। একটি হচ্ছে, শিক্ষকরা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন না এবং লেখালেখি ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধারণ মানুষের সংস্পর্শের বাইরে নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি টঙ্গিতে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। ওই সময় প্রতিষ্ঠিত হওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি যে কারণে শহর থেকে দূরে নির্বাচন করা হয়।

সমকাল: রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাৎপর্য আপনি বললেন। এর শিক্ষার মান কেমন ছিল?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শিক্ষার মান খুবই ভালো ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ছাত্র ও শিক্ষক বিদেশে পড়াশোনার জন্য যেত, তারা কৃতিত্বের পরিচয় দিত। আমি নিজে পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ডে গিয়েছিলাম ষাটের দশকে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সেখানকার সমাজ ততটা চিনত না। কিন্তু এর ছাত্র ও শিক্ষকদের কৃতিত্বের কারণে তাদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম জানত। পড়াশোনার মান ভালো থাকার একটি বড় কারণ হচ্ছে, পাকিস্তান আমলে এটা মোটামুটি অনিবার্য ছিল যে কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করলে কোনো না কোনো চাকরি হবেই। সে বেকার থাকবে না। সেটা তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের জন্যও বড় সুযোগ এনে দিত। যে কারণে পূর্ব পাকিস্তানের সব মেধাবী ছাত্রছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য এবং ভর্তি হওয়ার পর পড়াশোনা ভালোভাবে করার জন্য নিবেদিত থাকত। আমি শিক্ষক হিসেবে বলি_ একজন শিক্ষক কতটা ভালো পড়াবেন, সেটা অনেকাংশে নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের আগ্রহের ওপর। ফলে শিক্ষকরাও ছিল নিবেদিত। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, কেবল পড়াশোনায় ভালো নয়; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবেও নেতৃত্বে থাকত।

সমকাল: কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রযোজিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের সর্বোচ্চ অর্জন স্বাধীনতার পর আমরা দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানে গুরুতর অবনতি ঘটল। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মানও আগের মতো রইল না। সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এর কারণ কী?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত, স্বাধীনতার আগে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি স্থির লক্ষ্য ছিল এবং সেই প্রয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ ও নিবেদিত ছিল। স্বাধীনতার পর সেটার প্রয়োজন আর ছিল না। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার পর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে গেল। সেই তুলনায় অবকাঠামো ও শিক্ষক ছিল না। ফলে শিক্ষার মান কমে যেতে থাকে। আবার পাকিস্তান আমলে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত সমাজ স্বাধীনতার পর পাকাপোক্ত ও বৃহত্তম আকার ধারণ করে। তারা গড়ে উঠেছিল ধনবাদী ত্রুটি নিয়ে। সেই মধ্যবিত্ত সমাজের সন্তানরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ও পড়াতে এলে এর চরিত্রেও রূপান্তর ঘটে। স্বাধীনতার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের প্রবণতা ছিল জাতীয়ভাবে বাঙালির বিকাশ। স্বাধীনতার পর পুঁজিবাদের প্রভাবে সবাই নিজে বড় হতে চাইল। অন্যের জন্য ভাবার প্রবণতা থাকল না। আবার শিক্ষার্থীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এবং দেশে আরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবং স্বাধীনতার পরপর অর্থনীতি বিধ্বস্ত থাকায় বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে গেল। আগে যেমন পাস করলেই চাকরি পাওয়া যেত, সেই পরিস্থিতি আর থাকল না। ফলে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ অনেক কমে গেল। স্বাধীনতার পর আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় ছিল যে বৃত্তি নিয়ে বিদেশে গিয়ে আর ফিরে না আসা।

সমকাল: অভিযোগ রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার মতো একাডেমিক কার্যক্রমও কমে যাওয়ার। র‌্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়ছে ক্রমাগত।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: স্বাধীনতার পর মেধাবীরা শিক্ষকতায় যোগ দেওয়ার বদলে প্রশাসনসহ অন্যান্য পেশায় বেশি যোগ দিতে থাকে। কারণ শিক্ষকতায় অর্থ কম। আর সমাজের ভোগবাদী রূপান্তরের ফলে অর্থই হয়ে দাঁড়িয়েছে মর্যাদার মাপকাঠি। গবেষণা এখনও হচ্ছে। কিন্তু সেটা হচ্ছে ফরমায়েশি। কোম্পানির কাজে লাগে, বিপুল জনগোষ্ঠীর কাজে লাগে না। আর আগে গবেষণা দিয়ে, প্রবন্ধ দিয়ে পদোন্নতি হতো। এখন তো পদোন্নতির জন্য এগুলোর ভূমিকা নগণ্য। বরং দলবাজি, লেজুড়বৃত্তির ভূমিকা বেশি। ফলে গবেষণায় আগ্রহী হবে কেন? আর র‌্যাংকিংকে আমি খুব বড় বিষয় মনে করি না। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভূমিকা ও গৌরব রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে। সেটা কি র‌্যাংকিংয়ে হিসাব করা হয়?

সমকাল: পড়াশোনার মান অবনতির পাশাপাশি আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার মানে, ক্যাম্পাসে এখন যে নানা নেতিবাচক চিত্র দেখি, তার সূচনাও কি হয়েছিল স্বাধীনতার পর?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, মূলত স্বাধীনতার পর ছাত্র রাজনীতিতে হানাহানি ও সংঘাত বেড়ে যায়। শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি বেড়ে যায়। আগে হলে আসন বণ্টন হতো মেধার ভিত্তিতে। সেখানে কে কোন ছাত্র রাজনীতি করে, তা বিবেচনার বিষয় ছিল না। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হতো। তাদের কেউ জোর করতে পারত না। এখন তো শুনি জোর করে মিছিলে নিয়ে যায়, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করে। অনেক সময় ক্লাস বা পরীক্ষা বাদ দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিয়ে যায়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে আবার ছাত্র রাজনীতিতে নেতৃত্ব পর্যায়ে থাকা ব্যাক বেঞ্চাররা, দুর্বৃত্তরা।

সমকাল: ছাত্র রাজনীতিতে ব্যাক বেঞ্চার, দুর্বৃত্তদের এই দাপট বেড়ে গেল কেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এর প্রধান কারণ ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া। যে কারণে ছাত্র রাজনীতি করেন যারা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা নেই। নব্বইয়ের দশকের আগ পর্যন্ত ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ সক্রিয় ছিল, নিয়মিত নির্বাচন হতো। ফলে ছাত্র রাজনীতিকদের নির্বাচনের কথা ভাবতে হতো। হলে হলে নির্বাচন হতো। সেখানে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই অংশ নিত এবং তাদের কেউ বিজয়ী হতো। যারা মাস্তানি করবে, তারা তো ভোট পাবে না।

সমকাল: পরিত্রাণের উপায় কী?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এজন্য কিছু সংস্কারমূলক কার্যক্রম নিতে হবে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুস্থ রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা ফিরিয়ে আনতে হবে। হলে হলে আগে যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হতো, খেলাধুলার আয়োজন, বিতর্ক প্রতিযোগিতা হতো, সেগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজন ছাত্র সংসদকে সক্রিয় করা।

সমকাল: প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: স্বাধীনতার পর উচিত ছিল উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা বাংলা চালু করা। তাতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্য সম্পর্কে গভীরতা অর্জন করত। কারণ আমাদের ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থী ইংরেজি ভালোভাবে বোঝে না। কিন্তু এজন্য যে অনুবাদ, প্রজ্ঞা ও চর্চা দরকার; তা নেই। আমি চাই মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা প্রচলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নেতৃত্ব দিক। মাতৃভাষার মধ্যেই নিহিত রয়েছে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: শেখ রোকন

সূত্র: সমকাল

You must be logged in to post a comment Login

মন্তব্য করুন