আধুনিককাল পর্বের নাট্যকার সেলিম আল দীন

সেলিম আল দীন বাংলা ভাষার আধুনিককাল পর্বের অন্যতম নাট্যকার। তিনি ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট সীমান্তবর্তী ফেনি জেলার অন্তর্গত সোনাগাজী উপজেলার সেনেরখিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
সেলিম আল দীনের লেখাপড়ার শুরু হয়েছিল আখাউড়ায় গৃহশিক্ষকের কাছে। এর কিছুদিন পর সেনেরখিল প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। তারপর মৌলভীবাজার বড়লেখার সিংহগ্রাম হাইস্কুল, কুড়িগ্রামের উলিপুরে মহারাণী স্বর্ণময়ী প্রাইমারী স্কুল এবং রংপুর ও লালমনিরহাটের স্কুলে পড়েন। পরে নিজ গ্রাম সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯৬৪ সালে। ফেনী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। টাঙ্গাইলের সাদত কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ. ডিগ্রি করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ বদলে দিয়েছিল সেলিম আল দীনের জীবনের গতিপথ। একদিন ক্লাসে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কারা কবিতা লেখ?’ সেলিম আলো দীনসহ কয়েকজন মহা-উত্সা্হে দাঁড়ালে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তাঁদের বলছিলেন, ‘তোমরা বেরিয়ে যাও।’ সবাই অবাক। কিন্তু মুনীর স্যারের কথা, টু শব্দ না করে সবাই মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে না বাড়াতেই তিনি তাঁদের বললেন, ‘বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দের মতো কবি এসেছেন, আরও কত কবি আছে বিশ্বসাহিত্যে, কবির কোনো শেষ নেই, শেষ নেই কবিতারও। তোমাদের মধ্যে কে জোর দিয়ে বলতে পারবে যে সে জীবনানন্দ দাশের চেয়ে ভাল কবিতা লিখতে পারবে? যদি না পার তাহলে কেন কবিতা লেখা?” কিন্তু সেদিন মুনীর স্যারের কথার উত্তর না দিয়ে সবাই চুপ করে রইল। তখন তিনি বললেন, ‘তবে যারা নাটক লিখতে চাও তারা থাকতে পার।’ এটা ছিল কবি হতে চাওয়া সেলিম আল দীনের জীবনে ধাক্কা। এর আগে আহসান হাবীবও তাকে বলেছিলেন নাটক লিখতে, মুনীর চৌধুরী তাগাদা দিলেন আর বিষয়টা চূড়ান্ত করলেন আহমদ শরীফ।
একদিন অধ্যাপক আহমদ শরীফ ক্লাশে কয়েকজনকে ছোট ছোট কয়েকটা প্রশ্ন করলেন, বেশির ভাগই তার প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে না পারায় তিনি বললেন, ‘তোমরা তো কোন লেখাপড়া করনি, কোনকিছু জান না।’ কথাটা সেলিম আল দীনের মনে খুব লেগেছিল, তাই তিনি সেদিন বলেই ফেলছিলেন, ‘আমি স্কুল-কলেজে থাকতে যা পড়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা পড়েছেন কিনা সন্দেহ।”তিনি এভাবে বলতে পেরেছিলেন কারণ তিনি লিখেছিলেন ‘আমেরিকান নিগ্রো সাহিত্য’ নামে একটি প্রবন্ধ, অনুবাদ করেছিলেন বিভিন্ন ভাষার গল্প। তিনি আহমদ শরীফকে সেদিনই জানালেন, তিনি নাটক লেখেন, পরদিন রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তার লেখা একটি নাটক প্রচারিত হবে। তার বিশ্বাস, এরকম নাটক এর আগে খুব একটা হয়নি। পরের দিন স্যার ডেকে পাঠালে কাঁপা কাঁপা বুকে অধ্যাপক আহমদ শরীফের কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন তিনি। ভেতরে কাজ করছিলেন অধ্যাপক শরীফ, সালাম শুনে মাথাটা একটু তুলে বললেন, ‘তোমার নাটক দেখলাম। তোমার অহংকার স্বার্থক।’ এভাবেই আহসান হাবীব, মুনীর চৌধুরী, আহমদ শরীফ তার শিল্পের পথকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন এবং করোটিয়ায় পেয়েছিলেন কবি রফিক আজাদের সাহচর্য, যা তার শিল্পযাত্রাকে আরো বেগবান করেছিল।
কর্মজীবনের শুরুতে সেলিম আল দীন বিজ্ঞাপন সংস্থা ‘বিটপী’তে কপি রাইটারের পদে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৬ সালে তিনি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে বিভাগে যোগদান এবং শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। প্রথাগত শিক্ষকের মতো শুধুমাত্র শ্রেণীকক্ষেই পাঠদান, পরীক্ষা, খাতা দেখা, ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন না তিনি। ক্লাসের বাইরেও তাঁর সৃজনশীল কাজের অংশীদার করে তুলতেন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষকতার পাশাপাশি এ দেশের নাট্যশিল্পকে বিশ্বনাট্য ধারার সঙ্গে সমপংক্তিতে সমাসীন করার লক্ষ্যে ১৯৮১-৮২ সালে তিনি এবং নাট্য-নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ সারাদেশব্যাপী গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার।
সেলিম আল দীন জীবদ্দশায় একজন নাট্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও সমকালীন বিশ্বের শিল্পধারায় নতুন নন-জেনরিক শিল্পধারার প্রবর্তনে সচেষ্ট ছিলেন। উল্লেখ্য, তিনি নাট্যকার পরিচয়ের বাইরে ছিলেন-একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, সংগঠক, নাট্যনির্দেশক এবং শিল্পতাত্ত্বিক। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে তিনি অন্যান্যদের সঙ্গে গঠন করেন ঢাকা থিয়েটার ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। মূলত ঢাকা থিয়েটারের সাংগঠনিক কাঠামো থেকে তিনি তার নিরীক্ষামূলক নাট্য রচনা ও তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তিনি শুধু নাটক রচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, নাট্যবিষয়ক বহু গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা পূর্বক বাঙলা নাটকের সহস্র বৎসরের ইতিহাস এবং তার একটি সুস্পষ্ট আঙ্গিক নির্মাণেও সমর্থ হন, রচনা করেন মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য (১৯৯৬)। বাঙলা ভাষার একমাত্র নাট্যবিষয়ক কোষগ্রন্থ বাঙলা নাট্যকোষ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদন করে বাঙলা নাট্যের কোষগ্রন্থের অভাব পূরণ করতেও সক্ষম হয়েছেন তিনি। নাট্য বিষয়ক গবেষণা পত্রিকা থিয়েটার স্টাডিজ-এর সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এছা্ড়া, নাট্যশিক্ষার্থীদের জন্য তিনি অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন নাট্যবিষয়ক গ্রন্থ নন্দিকেশ্বরের অভিনয় দর্পণ (১৯৮২)। তার প্রকাশিত অন্যান্য সাহিত্যকীর্তির মধ্যে রয়েছে- কাব্যগ্রন্থ-কবি ও তিমি (১৯৯০), উপন্যাস-অমৃত উপাখ্যান (২০০৫)। তাঁর রচিত সব সৃজনকর্ম নিয়ে ৫খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র [১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ (২০০৫-২০০৯)]। তার রচিত হরগজ নাটকটি সুইডিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল কর্তৃক হিন্দি ভাষায় মঞ্চস্থ হয়েছে। সেলিম আল দীনের নাটক ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। তার উল্লেখযোগ্য নাটক ও নাট্যগ্রন্থ- সর্প বিষয়ক গল্প ও অন্যান্য নাটক (১৯৭৩), জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন (১৯৭৫), বাসন (১৯৮৫), তিনটি মঞ্চ নাটক: মুনতাসির, শকুন্তলা ও কিত্তনখোলা (১৯৮৬), কেরামতমঙ্গল (১৯৮৮), প্রাচ্য (১৯৯৮), কিত্তনখোলা (১৯৮৯), হাতহদাই (১৯৯৭), যৈবতী কন্যার মন (১৯৯৩), চাকা (১৯৯১), হরগজ (১৯৯২), একটি মারমা রূপকথা (১৯৯৫), বনপাংশুল (১৯৯৬), নিমজ্জন (২০০২), ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল (২০০৭), ঊষা উৎসব ও স্বপ্নরমণীগণ (নৃত্যনাট্য, ২০০৭), পুত্র (২০০৮) ইত্যাদি।
নাট্য ও গবেষণামূলক রচনাকর্মের পাশাপাশি সেলিম আল দীন টেলিভিশন নাটক রচনা, চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনা ও মঞ্চনাট্যের নির্দেশক হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে এবং ঢাকা থিয়েটার তিনি যে সব নাটকের নির্দেশনা দেন সেগুলো হলো- মহুয়া (মৈমনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে) (১৯৯০), দেওয়ানা মদিনা (মৈমনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে) (১৯৯২), একটি মারমা রূপকথা (মারমা রূপকথা ‘মনরিমাংৎসুমই’ অবলম্বনে) (১৯৯৩), কাঁদো নদী কাঁদো, মেঘনাদবদ (অভিষেক নাম পর্ব)। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত একাত্তরের যিশু চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর নাটকের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে একধিক চলচ্চিত্র, যেমন- ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর চাকা নাটকের চলচ্চিত্রায়ন করেন চলচ্চিত্র পরিচালক মোর্শেদুল ইসলাম এবং ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর কিত্তনখোলা নাটক নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন আবু সাইয়িদ।
নাট্যকার সেলিম আল দীন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব, ফিউশন তত্ত্ব’র প্রবক্তা এবং নিউ এথনিক থিয়েটারের উদ্ভাবনকারী। বাঙলা নাটকে অসামান্য অবদানের জন্য দেশে বিদেশে তিনি বহুবার সংবর্ধিত এবং জাতীয় পুরস্কারসহ বহু পরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েক পুরস্কার হলো- বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৬), নান্দীকার পুরস্কার (আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা, ১৯৯৪), শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার (টেনাশিনাস পুরস্কার) (১৯৯৪), খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (একাত্তরের যীশু, শ্রেষ্ঠ সংলাপ) (১৯৯৪), একুশে পদক (২০০৭), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (২০০৭) ইত্যাদি। ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়।
You must be logged in to post a comment Login