বিডি সাইক্লিস্ট বৃত্তান্ত

প্রকাশ: May 14, 2015
11218516_841268879273315_8836908953498162240_n

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল৷ ধসে পড়েছে সাভারের রানা প্লাজা৷ ভবনের মধ্যে আটকে পড়া শত শত শ্রমিককে উদ্ধারের জন্য চলছে বহু মানুষের নানামুখী তৎপরতা৷ কেউ ওষুধ, কেউ রক্ত, কেউ খাদ্য —যে যেভাবে পারছেন সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসছেন৷
কিন্তু সেই ঘটনার দিন থেকেই পুরো এলাকায় যানজট৷ ফলে সারা দেশ থেকে সংগৃহীত ওষুধ সময়মতো সেখানে পৌঁছানো কিছুটা হলেও ছিল দুরূহ৷ এরই মধ্যে দেখা গেল, একদল স্বেচ্ছাসেবী বাইসাইকেলে চেপে মাত্র ৪০ মিনিটে ঢাকা থেকে সাভারে ওষুধ পৌঁছাতে পারছেন৷

এই স্বেচ্ছাসেবীর দলটি বিডি সাইক্লিস্ট গ্রুপের সদস্য৷ গ্রুপটির যাত্রা শুরু সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেসবুকের মাধ্যমে৷ সাভারে ওষুধ পৌঁছানোর মানবিক কাজটি করা গ্রুপটির তাৎক্ষণিক কোনো তৎপরতা ছিল না৷ তার শিকড় আরও গভীরে, সারা দেশে৷ তাঁরা দুই চাকার জগৎকে নতুন করে হাজির করেছেন৷ সামনে নিয়ে এসেছেন পরিবেশবান্ধব জীবনধারা৷
6982_630022940397911_8924084_n
এখন প্রায় ৩৮ হাজার সদস্য আছেন এ গ্রুপে৷ এর মধ্যে নিয়মিত সাইকেল চালাচ্ছেন কয়েক হাজার সদস্য৷ দিন যাচ্ছে, সংখ্যাটাও বাড়ছে৷
বাইসাইকেল চালাতে চালাতে একে অপরকে চেনাজানা, সবাই মিলে একসঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাওয়া—সব মিলিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতার নতুন এক জগতের সন্ধানই যেন পেয়েছেন তরুণেরা।
533628_393230790743795_196078826_n
আর বাইসাইকেলের এ নতুন দিনের সূচনা করেছেন মোজাম্মেল হক, কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে৷ মোজাম্মেল হক পেশায় সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার৷ তবে তাঁর অফিসের ডেস্ক দেখে মনে হতে পারে ভুল করে বাইসাইকেলের কোনো শোরুমে ঢুকে পড়েছেন! ডেস্কের সামনে বাইসাইকেল, পেছনে বাইসাইকেল, ডানে বাইসাইকেল—বাইসাইকেলময় অফিস।
10269406_653440531389485_3397994658383377631_n
বিডি সাইক্লিস্ট গ্রুপের পথচলা শুরু ২০১১ সালের ১৭ মে থেকে।মোজাম্মেল হক জানান, ‘২০০৫ সালে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসর থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে আসি। পান্থপথের বাসা থেকে গাড়িতে করেই বনানীর অফিসে যেতাম। পরে ২০০৮ সালে মিরপুরের এখনকার অফিসে যোগ দিই। গাড়িতে করে পান্থপথ থেকে মিরপুর যেতে-আসতে সময় লাগত তিন ঘণ্টার মতো। কিছুদিন বাদে মোটরসাইকেলে করে অফিসে যেতে শুরু করলাম। সেটাতেও সময় লাগত দেড় ঘণ্টার মতো। তবে তখনো আমি সাইকেল নিয়ে ভাবিনি।’
1385277_552344961499043_538655216_n
২০০৯-১০ সালের দিকে নেপালে গিয়ে চোখ খুলে গেল মোজাম্মেল হকের। যে বাইসাইকেলটা দিয়ে তিনি পাহাড়ে ট্রেইল করেন, সেটাই কিনে আনেন দেশে, শুরু হলো বাইসাইকেলে চেপে অফিসে যাতায়াত, সময় লাগে মোটে ২০-২৫ মিনিট!
13789_825279757538894_4600533142672164407_n
মোজাম্মেল হক পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। একটি বেসরকারি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তো, সময় বাঁচানোর ক্ষেত্রে তার এই আইডিয়া তার অফিস কলিগ ও অন্যান্য পরিচিতজনদের উৎসাহিত করে।

কদিন পরেই সবাই মিলে সপ্তাহের শুক্রবার সকালে ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে শুরু করলেন বাইসাইকেল ভ্রমণ।
মোজাম্মেল হকের যুক্তি, ‘আমাদের গড় আয়ু যদি ৬৫-৬৭ বছর ধরি, তাহলে যানজটেই কেটে যায় ১০-১২ বছর। অথচ বাইসাইকেলে অফিসে যাতায়াতের ফলে ওই সময়গুলো বেঁচে যাচ্ছে আমার। এই সময়টায় কত কিছুই না করতে পারি!’
10269610_643566305710241_6599634221984366705_n
সব ভেবে মোজাম্মেল ও তাঁর বন্ধুরা ফেসবুকে খুলে ফেললেন বিডি সাইক্লিস্ট গ্রুপ৷দিনে দিনে আরও তরুন তরুনীরা জড়ো হয় তাদের দলে। প্রতি সপ্তাহে একদিন দলবেধে তারা সারা শহরে ঘুরে বেড়াতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে তারা নিজেদের যাত্রায় সময় ও স্থান ঠিক করে নেয়।
ফেসবুকে বিডি সাইক্লিস্ট নাম দিয়ে তারা একটি গ্রুপ তৈরি করে ২০১১ সালে, যাদের বর্তমান সদস্য সংখ্যা পয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি।
এখন, ঢাকার যানজটের এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে এ শহরের বাসিন্দাদের শতকরা ৫ জনকে পরিবহন হিসেবে সাইকেলকে বেছে নেয়ার জন্য উৎসাহিত করতে কাজ করছে বিডি সাইক্লিস্ট।
1466135_581838878549651_1373686307_n
সেইসাথে, তারা একটি ওয়েবসাইটও চালু করেন যেখানে শহরের বিভিন্ন সাইকেল বিক্রয়কেন্দ্রের নানা তথ্য এবং সাইকেলের দরদাম ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহিদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন বিডি সাইক্লিস্টের সদস্যরা।

মূলত, তাদের অনুপ্রেরনায়ই এখন ঢাকার ব্যস্ত সড়কে মাথায় হেলমেট পরে তরুণ তরুণীদের এখন নিয়মিতই সাইকেল চালাতে দেখা যায়; যা শুধুমাত্র শখের বশে নয়, তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ।
10001429_800807563319447_8309002514007377430_n
এখন ঢাকায় কমবেশি প্রায় ৬০,০০০ মানুষ সাইকেলে যাতায়াত করেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ন দিবস এবং নানা উৎসব স্মরনীয় করে তোলার জন্য বিডি সাইক্লিস্ট নানান ইভেন্টেরও আয়োজন করে যাচ্ছেন বলে জানান মোজাম্মেল।

যানজটের শহর ঢাকার একজন তরুণ যাতায়াতের জন্য সাইকেল ব্যবহার করে মাসে অন্তত ১৫ ঘন্টা সময় বাঁচাতে পারেন বলে জানান সংগঠনটি সদস্যরা।ঢাকার মতো যানজটপূর্ন শহরে একমাত্র সাইকেলই সে নিশ্চয়তা দেয়। ফলে, এ শহরে সাইকেল চালানোর জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও সুযোগ সুবিধা থাকা দরকার।‘
10675653_769065516493652_1087426243630302988_n
সেইসাথে, ঢাকার রাস্তায় সাইকেলের জন্য আলাদা লেন তৈরি করার বিষয়ে আশা প্রকাশ করেন তিনি।এ অবস্থার প্রেক্ষিতে, দেশে সাইকেলের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে সরবরাহের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন দেখা যায়।

এই সাইক্লিস্ট সংগঠনটির নিয়মিত কার্যক্রম, বিভিন্ন ইভেন্টে আয়োজন, আর্ত মানবতার সেবায় অংশগ্রহন এবং অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রম ইতিমধ্যেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে।

*বিডি সাইক্লিস্ট নিয়ে আমরা ঢাকার অন্যান্য প্রতিবেদন:
দূষণমুক্ত ঢাকা গড়তে সাইকেল

You must be logged in to post a comment Login

মন্তব্য করুন